জ্যোৎস্না রাত - Hridom



-এই তুমি খালি গায়ে কোথায় যাও!
-ছাদে।
-ছাদে যাবে, তো খালি গায়ে কেন!
-আজ জ্যোৎস্না রাত,দেখছনা?
-দেখবোনা কেন, কিন্তু তাতে কি?
-আমি জ্যোৎস্না স্নান করবো। কাপড়
পরে কি স্নান হয়?
-ফাইজলামি করবেনা আমার সাথে।
চাঁদনী রাতে অনেকেই ছাদে হাটে, ঘর
থেকে বেরোয় কিন্তু
খালি গায়ে জ্যোৎস্না উপভোগ
করে কয়জন?
-কেউ না করলেও আমি করি। আর অন্য
কেউ যে এমন করেনা তার
তো নিশ্চয়তা নেই। লক্ষ কোটি মানুষের
কে কি করে তুমি নিশ্চই জাননা।
-তোমার এইসব উদ্ভট যুক্তি আর
কাণ্ডকারখানা আমার অসহ্য লাগে।
-আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে আমি গেলাম।
তুমিও আসতে পার।
-এই যাবেনা বলছি,শুনো।
কিন্তু অন্তু
ততক্ষনে চলে গেছে দরোজাটা খুলেই।
সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ
শুনতে পাচ্ছে সামিয়া। অন্তু আর
সামিয়ার বিয়ে হয়েছে প্রায় বছর
খানেক। এরেঞ্জ ম্যারেজ তাদের।
পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক অন্তু।
বাবা মার ইচ্ছাতেই বিয়ে করেছে ওরা।
রীতিমত
ঘটক,কনে দেখা,পানচিনি অনুষ্ঠান সব
হয়েছে। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই
সামিয়া লক্ষ করছে অন্তু কেমন যেন
উদাস থাকে। মাঝ রাত্রিতে ঘুম
ভাঙ্গলে অনেক সময় দেখা যায়
বেলকনিতে বসে আছে অন্তু। একের পর এক
সিগ্রেট ফুঁকছে। কখনো দেখা যায়
সামিয়াকে ঘুম
থেকে ডেকে তুলে বলে "এই
সামিয়া আমার ঘুম আসছেনা,গল্প
করি উঠ।"
বাচ্ছা নেয়ার ব্যাপারেও ঘোর
অনীহা অন্তুর। বললেই বলবে"এত অস্থির
হবার কি সামিয়া,সবেতো বিয়ে হলো।
যাকনা কিছুদিন।"
সামিয়া কিছুতেই বের
করতে পারছেনা অন্তুর উদাসীনতার
পিছে লুকিয়ে থাকা রহস্যগুলো।
সামিয়াকে প্রকৃতি তেমন আকৃষ্ট
করতে পারেনা। বৃষ্টি,চাঁদনী রাত
কিংবা গোধুলীর আলো এসব তার
কাছে আহামরি কিছু না কিন্তু অন্তুর
কাছে এসবই মনে হয় জীবন।
ভাবতে ভাবতে সামিয়া উঠে দাঁড়ালো।
দেখে আসতে চায় রহস্যময় স্বামীর
খালি গায়ের জ্যোতস্না স্নান।
ওইতো অন্তু ছাদের দক্ষিন ধারে হাটছে।
এই রকম চাঁদের আলোতে একটা মানুষ
খালি গায়ে হেটে বেরাচ্ছে।
দৃশ্যটা বিধঘুটে। অন্তত সামিয়ার কাছে।
সামিয়া ধীরে ধীরে পা ফেলে অন্তুর
পাশে গেল।
(২)
-অহ তুমি এসেছ,তোমাকে আজ কিছু
জিনিস
দেখাবো যা আগে কখনো বলিনি।
-সব কিছু দেখবো তবে তার আগে তোমার
কাপড় পরতে হবে। এই
স্যান্ডো গ্যাঞ্জিটা গায়ে দাও।
অন্তু অসহায় ভাবে সামিয়ার হাতের
গ্যাঞ্জিটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ছোট বাচ্ছা যেমন তেতো ঔষুধ খাওয়ার
আগে অসহায়ত্ব মুখে ফুটিয়ে তুলে ঠিক
তেমনি।
-না পরলেই কি নয়?
-না।
-ওকে,দাও।
একরকম বাধ্য হয়ে গেঞ্জিটা পরলো অন্তু।
-এবার বলো কি বলবে? সামিয়ার প্রশ্ন।
-ইচ্ছে করছেনা আর সামিয়া।
-না করলে নেই।
-সামিয়া একটা কথা বলবে?
-কি?
-আমাকে কি তোমার পাগল মনে হয়?
-হয়।
-
তুমি আমাকে বিয়ে করে সুখী নও,তাইনা?
-আমি জানিনা অন্তু।
-আমি জানি,আমি সুখী হতে পারিনি।
-কি!
-হে। তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।
-কি?
-আমাদের কিছু দিন
আলাদা থাকা উচিৎ।
-তারপর?
-আলাদা থেকে আমাদের একজন
আরেকজন সম্পরকে জানা উচিৎ।
-পিকুইলিয়ার টাইপ
কথা বলছো তুমি অন্তু!
একসাথে থেকে যা হয়নি সেটা আলাদা থেকে কিভাবে সম্ভব?
-সম্ভব।
(২)
-কি করছ সামিয়া?
-বসে বসে বোর হচ্ছি।
-কেন?
-আমার খুব একা লাগছে অন্তু।
-কেন?
-জানিনা।
-আমার মাথায় একটা প্লান
আসছে,শুনবে?
-আগামী কাল তোমার সাথে রমনায়
দেখা করবো!
-কি বলছো এসব?
-যা বলছি তাই।
-কাল বিকাল ৫ টায় তুমি রমনায়
দেখা করবে আমার সাথে। আর এখন খুব ঘুম
পাচ্ছে,কাল সকালে অফিসে গিয়ে সব
খোলে বলবো। এখন রাখি,তুমিও
ঘুমিয়ে পড়।
-আমার ঘুম আসছেনা।
-তাহলে এক কাজ করো,কাল
কি পরবে,কি করবে প্লান করতে থাকো।
আমি ঘুমাই।
-তুমি একটা পাগল, আচ্ছা ঘুমাও।
-ঘুমাচ্ছি,অহ শুনো। কাল বাজারের লিস্ট
দেয়ার দরকার নেই। বাই।
-ওকে,বাই।
কি অদ্ভুত এক সংসার চলছে এখানে। আজ
দশম দিন সামিয়া আর অন্তু কেউ
কারো মুখ দেখেনি। অথচ একই বাসায় একই
ছাদের নীচে বসবাস করছে। এটা অন্তুরই
প্লান। ওদের কেন জানি খিটিমিটি আর
মতবিরোধ লেগেই ছিল। অন্তুর প্লান
হচ্ছে, কিছুদিন আলাদা ঘুমাবে তারা,
কেউ কারো চেহারা দেখবেনা,
সামিয়া একা একাই রান্না করে খাবে,
অন্তু শুধু রাতের খাবারটা বাসায়
খাবে তবে নিজে রান্না করে, বাজারের
প্রয়োজন হলে সামিয়া লিস্ট
দেবে অন্তুকে, কেউ কারো সামনে ভুলেও
আসবেনা। এই অনুপস্থিতি বা অদেখাটাই
নাকি তাদের দূরত্বটা কমাবে। এক জনের
জন্য আরেক জনের
ভালবাসা বা ফিলিংসগুলো বিল্ড আপ
করবে। আর যদি কাজ না হয়
তবে তারা সেপারেশন করবে।
****
-৫ টা বেজে ২০ মিনিট অন্তু। ইউ আর লেট
টু মাচ।
-আর ৫ টা মিনিট প্লীজ,এইতো পৌঁছলাম
বলে।
-
অসহ্য,তুমি আরো আগে রওয়ানা দিলেনা কেন?
একটা মেয়ে এভাবে একা একা বসে থাকতে পারে?
আমার ভয় করছে।
-বললাম তো সরি,অফিস থেকে বের
হতে পারছিলাম না।
এইতো এসে গেছি,ভয়ের কিছু নেই।
আসলে দুজনেরই তর সইছেনা দেখা করার
জন্য। প্রেমিক প্রেমিকার প্রথম
দেখা করার মতোই যেন রোমাঞ্চকর কিছু
এটা। সামিয়া প্রথম থেকেই অন্তুর এইসব
পাগলামীর
বিরোধীতা করে আসছে কিন্তু নিজের
অজান্তেই সেও ফেঁসে গেছে এই খেলায়।
অন্তুর ঠিক যেরকম পছন্দ
তেমনি সেজে এসেছে সামিয়া।
শাড়ী অন্তুর পছন্দ না। কালোর
মাঝে সাদা প্রিন্টের সালোয়ার
কামিজ পরে এসেছে সামিয়া। মাথায়
ওড়না আর কপালের
একপাশে চুলগুলো ফেলে রাখা।
হাতে লাল আর সাদা গোলাপের
একটা ছোট তোড়া। হাতের এন্ড্রয়েড
ফোনের মিররে বার বার
দেখছে নিজেকে কেমন লাগছে?
খুশী হবেতো তাকে দেখে অন্তু? চাকরীর
ইন্টার্ভিউ দিতে গিয়েও হয়তো এত
চিন্তায় থাকেনা কেউ!
মনে প্রাণে প্রার্থনা করছে অন্তু যেন
খুশী হয় তাকে দেখে। বউ তো নয় যেন
প্রেয়সীর টেনশন। প্রেমিককে প্রথম
দেখায় রূপলাবণ্য দিয়ে কপোকাত করার
খেয়াল মনে হচ্ছে। এমন সময় ওর
ফোনটা বেজে উঠলো আবার। অন্তুর
ফোন।
-সামিয়া।
অন্তুর কণ্ঠে কেমন একটা অসহায় সুর
বাজছে।
-হুম বলো,কই তুমি?
-একটা সমস্যা হয়ে গেছে সামিয়া!
এমন কিছুই আন্দাজ করেছিল সামিয়া।
-কি?
-আমি আসতে পারবোনা। তুমি বাসায়
চলে যাও।
-হোয়াট?
সামিয়া কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।
রাগে দুঃখে সামিয়ার চোখে জল
এসে গেল। এত অপেক্ষা,এত সাধনা করার
পর এটা কি শুনলো সে?
পেটে বাচ্ছা ভেবে আলট্রাসনোগ্রাম
করে টিউমার দেখলেও হয়তো এতটা হতাশ
হতোনা সামিয়া।
-প্লীজ সামিয়া রাগ করোনা,অফিস
থেকে জরুরী ফোন আসলো এই মাত্র। মাঝ
রাস্তা থেকে ফিরে যাচ্ছি তাই।
সমস্যা নেই আমরা আজ বাসায়
দেখা করবো।
-অসম্ভব,কক্ষনো না। আমাদের আর
দেখাই হবেনা। আমি এখান
থেকে সোজা বাসায় যাচ্ছি,বাবার
বাসায়।
রাগে ফেটে পড়লো সামিয়া।
-
সামিয়া পাগলামী করনা প্লীজ,বোঝার
চেষ্টা কর।
-সাট আপ, আর একটাও
কথা বলবেনা তুমি। ফোন রাখলাম আমি।
লাইন কেটে দিয়ে মাথা নীচু
করে পার্কের
বেঞ্চে বসে থাকলো সামিয়া।
ফোটা ফোটা অবাধ্য চোখের জল
মওকা পেয়েই গড়িয়ে পরতে থাকলো।
ফুলের তোড়াটার দিকে চোখ যেতেই
সামিয়ার মনে হলো, লাল
সাদা গোলাপগুলো তাকে যেন উপহাস
করছে। হাতে নিয়েই ছুড়ে ফেলে দিল
ওগুলো। দশটা দিনের আলাদা থাকার
ফলস্বরূপ অন্তুর যে শূণ্যতা তার
হৃদয়ে সৃষ্টি হয়েছিলো সেসবও যেন
ফুলগুলির সাথে দূরে ঠেলে দিল। তারপর
উঠে দাঁড়ালো ফিরে যাবার জন্য।
অভিমানের
স্রোতে ভেসে ভেসে সিদ্ধান্ত নিয়েই
ফেলেছে বাবার বাসায় চলে যাবে।
ঘুরে যেই পা ফেলবে দেখে অন্তু
দাঁড়িয়ে আছে ওর ছুড়ে ফেলা ফুলের
তোড়াটা হাতে নিয়ে।
মুখে মায়া ভরা নিষ্পাপ একটা হাসি।
মানুষটা আহামরী সুন্দর বা স্মার্ট
না কিন্তু তার এই হাসিটা ভূবন
ভুলানো সন্দেহ নেই। ফুল
হাতা একটা আকাশী শার্ট
পরে এসেছে অন্তু, ছোট ছোট চুলে একদম
বাচ্ছা ছেলেদের মতো লাগছে।
সামিয়া কি বলবে বুঝতে পারছেনা।
আনন্দ,রাগ আর অভিমানের মিশেল
তাকে যেন হতবাক করে দিয়েছে।
অশ্রুদের দ্বিগুন উদ্যমে ঢল নেমেছে।
-তুমি একটা শয়তান অন্তু।
এই
বলে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো সামিয়া অন্তুর
বুকে।
-আরে আরে করে কি পাগলী! মানুষ
দেখছেতো। মুখ লুকালে হবে নাকি,
আমি আমার সুন্দরী বউটাকে দেখি।
তোমাকে না অসম্ভব সুন্দর
লাগছে সামিয়া।
কথাগুলো সামিয়ার
কানে গেছে কিনা বোঝা গেলোনা,
কারন সে আর অন্তুর বুক
থেকে মাথা তুলছেনা। শরীরের
কাঁপুনি দেখে অনুমান করা যায়
সে কাঁদচে।

কোন মন্তব্য নেই